- ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী
কিছু কমবখত এবং নাদান ইয়াজিদ প্রেমী পোস্ট দিয়ে বেড়ায় ইয়াজিদ নাকি তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিল। নাউজুবিল্লাহ! ইয়াজিদকে লানত না দিয়ে তার জন্য দুয়া করার পরামর্শ দেয় ওই নাদান মুসলমান নামধারীরা। বুখারি শরীফের একটি হাদিসের অপব্যাখ্যা করে তারা ইয়াজিদকে জান্নাতি প্রমাণ করার ও দুঃসাহস দেখায়। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত করবে না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আহলে বায়েতের প্রতি এমন অবিচারের কারণে তদের ঈমান ও আমল দুটোই বরবাদ হয়ে গেছে। এখন দেখা যাক কুরআন ও হাদিসের আলোকে ইয়াজিদ কি মুমিন রয়ে গেছে নাকি কুফরিতে পতিত হয়ে গেছে।
নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং আহলে বায়েতের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের শর্ত, ইয়াজিদ বা কোন লানতপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ নয়। তারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে যে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসেইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর সংগী সাথীদের হত্যা করে ইয়াজিদ (লাঃ) কুফরি করেনি, কবীরা গোনাহ করেছে। এর পক্ষে যদিও তাদের কোন দলীল নেই।
১। মুসলমান তো দূরের কথা, কোন কাফির বা মুশরিক যদি যুদ্ধ ক্ষেত্রেও জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলাম গ্রহণ করে তাকেও হত্যা করা নিষেধ। আর হত্যাকারী নিজেই শিরক আর কুফরে প্রত্যাবর্তন করে। দেখুন সহীহ মুসলিম এবং সহীহ বুখারির নিম্নের হাদিসগুলো।
প্রথম হাদিসঃ
আসওয়াদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। “ইয়া রাসুলুল্লাহ! এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন, যদি আমি কোন কাফিরের সম্মুখীন হই এবং সে আমার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়, তার তলোয়ার দ্বারা আমার একটি হাত উড়িয়ে দেয়, এরপর কোন গাছের আড়ালে গিয়ে বলে আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করলাম! এ কথা বলার পরও আমি কি তাকে কতল করতে পারি?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “তাকে হত্যা করো না।” আমি আরয করলাম, “হে আল্লাহর রাসুল! সে আমার একটি হাত কেটে ফেলে এ কথা বলেছে, তবুও কি আমি তাকে হত্যা করব না?” তিনি বললেনঃ “না, হত্যা করতে পারবে না। যদি তুমি তাকে হত্যা কর (তবে) এ হত্যার পুর্বে তোমার যে অবস্হান ছিল সে ব্যাক্তি সে স্হানে পৌছবে এবং কালিমা পড়ার আগে সে ব্যাক্তি যে অবস্হানে ছিল তুমি সে স্হানে পৌছবে।” [সহীহ মুসলিম ১৭৬, সহীহ বুখারি ৩৭৯৪]
দ্বিতীয় হাদিসঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের একটি বাহিনী মুশরিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পাঠালেন। উভয় দল পরস্পর সম্মুর্খীন হল। মুশরিক বাহিনীতে এক ব্যাক্তি ছিল। সে যখনই কোন মুসলিমকে হামলা করতে ইচ্ছা করত, সে তাকে লক্ষ করে ঝাপিয়ে পড়ত এবং শহীদ করে ফেলত। একজন মুসলিম তার অসতর্ক মূহৃর্তের অপেক্ষা করতে নাগলেন। জুনদুব বললেন, আমাদের বলা হলো যে, সে ব্যাক্তি ছিল উসামা ইবনু যায়িদ। তিনি যখন তার উপর তলোয়ার উত্তোলন করলেন তখন সে বলল, ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ তবুও উসামা (রাঃ) তাকে হত্যা করলেন। দুত যুদ্ধে জয়লাভের সুসংবাদ নিয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর খেদমতে হাযির হলেন। তিনি তার কাছে যুদ্ধের পরিস্হিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তিনি সব ঘটনাই বর্ণনা করলেন, এমন কি সে ব্যাক্তির ঘটনাটিও বললেন যে তিনি কি করেছিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে ডেকে পাঠালেন এবং প্রশ্ন করলেন, তুমি সে ব্যাক্তিকে হত্যা করলে কেন? উসামা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সে অনেক মুসলিমকে ঘায়েল করেছে এবং অমুক অমুককে শহীদ করে দিয়েছে। এ বলে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেন। আমি যখন তাকে আক্রমণ করলাম এবং সে তলোয়ার দেখে অমনি ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ বলে উঠল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কি তাকে মেরে ফেললে? তিনি বললেন, জি হ্যা। রাসুল বললেনঃ কিয়ামত দিবসে যখন সে ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ (কালিমা) নিয়ে আসবে, তখন তুমি কি করবে? তিনি আরয করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার মাগফিরাতের জন্য দু’আ করুন। রাসুল বললেনঃ কিয়ামত দিবসে যখন সে ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ (কালিমা) নিয়ে আসবে তখন তুমি কি করবে? তারপর তিনি কেবল এ কথাই বলছিলেনঃ কিয়ামতের দ্বীন যখন সে ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ (কালিমা) নিয়ে আসবে, তখন তুমি কি করবে? তিনি এর অতিরিক্ত কিছু বলেন নি। [মুসলিম ১৭৬]
তৃতীয় হাদিসঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বি আল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলমানদেরকে গালাগালি করা ফাসেকি আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কুফরী | [ বুখারী ৪৮, মুসলিম ৬৪ ]
উপরের এই তিনটি হাদিস ছাড়াও আরও অসংখ্য হাদিস রয়েছে এই কথার পক্ষে। উপরোক্ত হাদিসগুলোর আলোকে ইয়াজিদকে কি বলা যায়? এরপরও তারা যদি হাদিস অস্বীকার করে ইয়াজিদের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর লোভে মনে করে সে কুফরি করেনি বরং কবীরা গোনাহ করেছে তাহলে তাদের ঈমান চলে যাবে। জেনেশুনে কেউ একটি সহীহ হাদিসকে অস্বীকার করলে কুফরি হয়।
২। ইয়াজিদ বুখারী শরীফের হাদিস অনুসারে জান্নাতী?
যে হাদিসের অপব্যাখ্যা করে কিছু নবী-দুশমন ইয়াজিদকে জান্নাতী বানানোর অপচেষ্টা করে থাকে সে হাদিসটি হল নিম্নরূপ।
হযরত উমাইর ইবনে আসওয়াদ আনসী (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বর্ণনা করেন যে, তিনি হযরত উবাদা ইবনে সামিতের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) কাছে আসলেন। তখন উবাদা হিমস উপকূলে তাঁর একটি ঘরে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে উম্মে হারামও (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহা) ছিলেন। উমাইর বলেন, উম্মে হারাম আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে, তিনি আল্লাহর রাসূলকে (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছেন: “আমার উম্মতের প্রথম যে দলটি নৌযুদ্ধে অংশ নেবে – তারা যেন বেহেশতে যাওয়াটা নিশ্চিত করে ফেললো।” উম্মে হারাম বললেন: “ওগো আল্লাহর রাসূল, আমি কি তাদের অন্যতম?” তিনি ফরমালেন: “তুমি তাদের অন্যতম।” উম্মে হারাম বলেন, এরপর নবীজী (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমালেন: “আমার উম্মতের প্রথম যে দলটি কায়সারের নগরী আক্রমণ করবে – তারা মাগফূর (ক্ষমাপ্রাপ্ত)।” তিনি (উম্মে হারাম) বললেন: “আমিও কি তাদের অন্যতম?” আল্লাহর রাসূল (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমালেন: “না।” (বুখারী শরীফ, জিহাদ অধ্যায়, রোমানদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচ্ছেদ, হাদীছ নং ২৭২৩)
উল্লিখিত হাদীছ শরীফের আলোকে কিছু লোক মুসলিম উম্মাহকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করে যে, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া (২৬-৬৪ হিজরী) রোমানদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রথম মুসলিম বাহিনীতে ছিলো। কাজেই, নবীজীর (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) উল্লিখিত আশ্বাসের প্রেক্ষিতে সে জান্নাতি ও ক্ষমাপ্রাপ্ত! অথচ তাদের এ দাবি একেবারেই অসত্য বা ভিত্তিহীন। কেননা, আলোচ্য হাদীছ শরীফে দু’টি বিষয় পরিষ্কার বর্ণিত হয়েছে:
(১) এ উম্মতের প্রথম নৌবাহিনী। (২)। কায়সারের নগরী আক্রমণকারী প্রথম মুসলিম বাহিনী।
ইয়াজিদ এ দু’ বাহিনীর কোনোটিতে ছিলো কিনা – এ ব্যাপারে আল-কুরআনেতো নয়ই, হাদীছ শরীফেও কোনো বর্ণনা নেই। বাকি রইলো, ইতিহাসের গ্রন্থাবলী। আমরা এখন দেখবো যে, এ ব্যাপারে ইতিহাস কী বলে।
মুসলিম বাহিনীর কায়সারের নগরী আক্রমণ ও ইয়াজিদের অংশগ্রহণ:
(১) প্রথম মুসলিম নৌবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হযরত আমিরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু)। হযরত উছমান ইবনে আফফানের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) শাসনামলে তিনি রোম আক্রমণের অনুমতি চেয়েছিলেন এবং ৩২ হিজরীতে অনুমতি পেয়ে তিনি যুদ্ধ করে ইস্তাম্বুল (কন্সস্ট্যান্টিনোপল) জয় করেন। তখন ইয়াজিদ মাত্র ৬ (ছ’) বছরের শিশু। আর সে ঐ যুদ্ধে অংশ নেয় নি।
- সুত্রঃ {ইবনে আছীরের (৫৫৫-৬৩০ হিঃ) রচিত আল-কামিল ফীত তারীখ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং ২৫ ও ইবনে কাছীরের (৭০২-৭৭৪ হিঃ) রচিত আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ১৭৯}
(২) কায়সারের রোম নগরীতে মুসলিম বাহিনীর আক্রমণ:
প্রথম আক্রমণ: আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, মহানবী নিজেই (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) মুসলিম সেনাবাহিনীকে কায়সারের নগরী আক্রমণ করতে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি জামাদিউল উলা ৮ মোতাবেক, ৬২৯ খৃষ্টাব্দে ঐ এলাকা (কায়সারের নগরী) দ্রুত আক্রমণ করে অপরাধী গোত্রগুলোকে শাস্তি দিতে তাঁর ৩,০০০ সাহাবীর একটি দলকে (সারিয়্যা) পাঠিয়েছিলেন – যার নেতৃত্বে ছিলেন হযরত জাইদ ইবনে হারিছা, দ্বিতীয় কমান্ডার ছিলেন হযরত জাফর ইবনে আবি ত্বালিব ও তৃতীয় কমান্ডার ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম নেয় নি।
- সুত্রঃ {সাইফুর রহমান মুবারকপুরীর (১৯৪৩-২০০৬ খৃঃ) রচিত, আর-রাহীকুল মাখতুম}। এ যুদ্ধে নবীজী উল্লিখিত তিনজনের শাহাদাত বরণের সংবাদ আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন! আর এর নাম ছিলো মুতার যুদ্ধ। তখন ইয়াজিদের জন্মই হয় নি।
দ্বিতীয় আক্রমণ: আমরা যদি কায়সারের নগরীর অর্থ করি – তাহলে সেটা হবে, হিমস বা হোমস নগরী – যা হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) শাসনামলে ১৬ হিজরীতে মুসলিম বাহিনী জয় করছিলেন এবং এর কমান্ডার ছিলেন হযরত উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু)। এ বাহিনীতে হযরত ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) অংশ নিয়েছিলেন। তখনো ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া জন্মগ্রহণ করে নি। কেননা, সে জন্মগ্রহণ করেছে ২৬ হিজরীতে
- সুত্রঃ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ৭৬) ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান একজন সাহাবী ও আমিরে মুয়াবিয়ার ভাই ছিলেন।
তৃতীয় আক্রমণ: (আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) হযরত আমিরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) ৩২ হিজরীতে রোম আক্রমণ করে ইস্তাম্বুলে পৌঁছে যান – যখন ইয়াজিদ ছিলো ৬ বছরের শিশু।
- সুত্রঃ (সূত্র: আল-কামিল ফীত তারীখ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং ২৫ ও আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ১৭৯} এটিই ছিলো মুসলমানদের প্রথম নৌপথে রোম আক্রমণ।
চতুর্থ আক্রমণ: ৪২ হিজরীতে মুসলিম বাহিনী ইস্তাম্বুলের পথে রোম আক্রমণ করে।
- সুত্রঃ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ২৪)।
পঞ্চম আক্রমণ: পরের বছর, অর্থাৎ ৪৩ হিজরীতে মুসলিম বাহিনী হযরত বাশার ইবনে আর্তাহর (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) নেতৃত্বে আবারো ইস্তাম্বুলের পথে রোম আক্রমণ করে।
- সুত্রঃ (তারিখে ইবনে খালদুন, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং ৯ ও আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ২৪)।
ষষ্ঠ আক্রমণ: পরের বছর, অর্থাৎ ৪৪ হিজরীতে হযরহ খালিদ বিন ওয়ালিদের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) ছেলে হযরত আব্দুর রহমান বিন সহ (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) মুসলিম বাহিনী রোমে প্রবেশ করে এবং সেখানে শুধু শীতকালটা কাটায়। আর হযরত বাশার ইবনে আর্তাহর (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) তখন নৌপথে যুদ্ধ করেছিলেন।
- সুত্রঃ (আল-কামিল ফীত তারীখ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং ২৯৮) ।
সপ্তম আক্রমণ: ৪৬ হিজরীতে হযরত মালিক ইবনে আব্দিল্লাহ (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) রোম রাজ্যে ছিলেন। কথিত আছে যে, হযরত আব্দুর রহমান বিন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) একই বছর হিমসে ফিরে আসেন এবং ইন্তেকাল করেন। তিনি কন্সস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। এ আক্রমণের কথা কোনো ইতিহাসের বইতে লিখা না থাকলেও আবূ দাউদ শরীফে রয়েছে। যেমন-
হযরত আবূ ইমরান (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বর্ণনা করেন, আমরা মদীনা হতে ইস্তাম্বুল (কুস্তুনতুনিয়া বা কন্সন্ট্যান্টিনোপল) অভিমুখে যুদ্ধ-যাত্রা করলাম। আমাদের সেনাপতি ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদের ছেলে আব্দুর রহমান। রোমানবাহিনী ইস্তাম্বুল শহরের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে যুদ্ধের জন্যে দাঁড়িয়েছিলো। এরপর কেউ শত্রুসেনাদের উপরে হামলা করে বসলো। আমাদের লোকজন বলে উঠলো: থামো! থামো!! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ!!! সেতো নিজেই নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তখন হযরত আবূ আইউব আনসারী (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বললেন: “তোমরা নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না (সূরা আল-বাকারা:১৯৫)। এ আয়াত আমাদের আনসারদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছিলো। যখন আল্লাহ তাঁর নবীকে (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্য করলেন এবং ইসলামকে জয়ী করলেন – তখন আমরা বলেছিলাম যে, আমরা যুদ্ধে না গিয়ে ঘরে থেকে আমাদের সহায়-সম্পদ দেখাশুনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবো। তখন আল্লাহুতা’লা নাযিল করলেন: তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো এবং নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না (২:১৯৫)। ঘরে বসে থেকে মালামালের রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং যুদ্ধে না যাওয়াটাই হচ্ছে, নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া।” আবূ ইমরান বলেন: এ কারণেই আবূ আইউব (আনসারী) ইস্তাম্বুলে সমাহিত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ আঝ্ঝা ও জাল্লার রাস্তায় সব সময়ে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন।
- সুত্রঃ (সুনানে আবূ দাউদ, জিহাদ অধ্যায়, “তিনি আঝ্ঝা ওয়া জাল্লা ফরমান: তোমরা নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না” অনুচ্ছেদ, হাদীছ নং ২৫০৪)
উল্লিখিত বিস্তারিত বর্ণনা অনুসারে, হযরত আমিরে মুয়াবিয়ার (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) নেতৃত্বে যে মুসলিম সেনাবাহিনী ৩২ হিজরীতে প্রথমবার ইস্তাম্বুল আক্রমণ করে – সেটাই হচ্ছে, বুখারী শরীফে উল্লিখিত ক্ষমাপ্রাপ্ত দল। আর এটা পরিষ্কার যে, আবূ দাউদ শরীফে উল্লিখিত ইস্তাম্বুল আক্রমণকারী মুসলিম সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) ছেলে হযরত আব্দুর রহমান (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) – যিনি আল-কামিল ফীত তারীখের বর্ণনা অনুসারে ৪৬ বা ৪৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে এ ইস্তাম্বুল আক্রমণও ৪৬ হিজরীতে হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সিহাহ সিত্তাহর অন্তর্গত সুনানে আবূ দাউদের গ্রহণযোগ্যতা সকল ইতিহাসগ্রন্থের চেয়ে বেশি। সুতরাং হাদীছ শরীফ, ইতিহাস ও রিজাল (জীবনী গ্রন্থ) অনুসারে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, হযরত আব্দুর রহমান বিন খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বেই ৪৬ বা ৪৭ হিজরীর আগে মুসলিম সেনাবাহিনী ইস্তাম্বুল আক্রমণ করেছিলো।
অষ্টম আক্রমণ: অষ্টমবার যখন মুসলিম সেনাবাহিনী ইস্তাম্বুল আক্রমণ করে – তখন এ বাহিনীতে ছিলেন হযরত ইয়াজিদ ইবনে শাজরাহ শামী রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু। ইনি কোনোভাবেই ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া নন।
নবম আক্রমণ: ৪৯ বা ৫০ হিজরীতে আমিরে মুয়াবিয়া (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) হযরত সুফিয়ান ইবনে আউফের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) নেতৃত্বে রোমের শহরগুলো দখল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময়ের প্রথম দলে ইয়াজিদ অংশ না নেওয়ায় তিনি শাস্তি হিসেবে জোর করে ইয়াজিদকে দ্বিতীয় দলে অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনুল আছীর এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন: “এ বছর (৪৯ হিঃ) কিংবা কেউ কেউ বলেন ৫০ হিজরীতে আমিরে মুয়াবিয়া সুফিয়ান ইবনে আউফের নেতৃত্বে রোমের শহরগুলো দখল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি সেখানে সেনাবাহিনী পাঠালেন এবং তাঁর ছেলে ইয়াজিদকে নির্দেশ দিলেন তাতে যোগ দিতে। কিন্তু ইয়াজিদ তাতে যোগ দিতে গড়িমসি করলো। আর মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে চুপ থাকলেন। মুসলিম সেনারা এ অভিযানে অসুস্থতা ও ক্ষুধায় অনেক কষ্ট স্বীকার করলো। এ খবর পেয়ে ইয়াজিদ একটি দু’ লাইনের শ্লোক আবৃত্তি করলো: আমি ঐ বাহিনী থেকে কেন সতর্ক থাকবো না – যারা ফার্কানদোনায় (বর্তমানে গ্রীসের একটি পৌরসভা) জ্বর ও গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছে – যখন কিনা আমি মারওয়ানের ঘরে উম্মে কুলসুমের সঙ্গে শৌখিন পোশাক পরে আরামে শুয়ে আছি?” (আল-কামিল ফীত তারীখ)
উম্মে কুলসুম বিনতে আব্দিল্লাহ বিন আমির ছিলো ইয়াজিদের স্ত্রী। যখন মুয়াবিয়া ইয়াজিদের এ শ্লোক আবৃত্তির খবর পেলেন – তখন তিনি তাকে সুফিয়ান ইবনে আওফের কাছে রোমে পাঠানোর শপথ নিলেন – যেন তিনিও কষ্ট লাঘব করতে পারেন। (প্রাগুক্ত)
ইবনুল আছীরের (৫৫৫-৬৩০ হিঃ) চেয়েও অনেক প্রবীণ ঐতিহাসিক আল-মাসউদী (২৮২/২৮৩-৩৪৫ হিজরী) তাঁর “মুরূজুয যাহাবী ওয়া মা’য়াদিনিল জাওয়াহির” কিতাবে লিখেছেন: “মুয়াবিয়া মুসলিম সেনাবাহিনীর উন্নতির খবর পেয়ে তা ইয়াজিদকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেন। আর ইয়াজিদ বললো: এ (মুসলিম বাহিনীর জয়লাভের) উপলক্ষে আমি আমার মাতাল বন্ধুদের নিয়ে বাড়ীতে একটি পার্টি দেবো!”
সুতরাং উল্লিখিত বিবরণগুলোর আলোকে এটা পরিষ্কার যে,
১। নবীজী (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) প্রথম যে দু’ সেনাবাহিনীর ব্যাপারে বেহেশত নিশ্চিত হওয়ার ও ক্ষমাপ্রাপ্তির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন – ইয়াজিদ তাতে অংশ নেয় নি, বরং সে নবম বাহিনীতে অংশ নিয়েছিলো।
২। কিছু অর্বাচীন ব্যক্তি মানুষকে গোমরাহ করতে অপপ্রচার (প্রোপাগান্ডা) করে বেড়ায় যে, ইয়াজিদ ঐ বাহিনীর সেনাপতি ছিলো; আর ইমাম হুসাঈন (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) নাকি সাধারণ সৈনিক হিসেবে তাতে যোগ দিয়েছিলেন! ডাহা মিথ্যে কথা!! বরং সত্য হচ্ছে, ইয়াজিদ নয়, বরং হযরত সুফিয়ান ইবনে আউফ (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) ঐ (নবম) বাহিনীর কমান্ডার বা সেনাপতি ছিলেন।
৩। জিহাদে অংশগ্রহণে ইয়াজিদের কোনোই আগ্রহ ছিলো না। আর তাই, সে মুসলিম বাহিনীতে অংশ নেয় নি। এতে পরিষ্কার হলো যে, হাদীছ শরীফে বর্ণিত ইস্তাম্বুল অভিযানে প্রেরিত জান্নাতি ও ক্ষমাপ্রাপ্ত প্রথম নৌবাহিনীতে সে কোনোভাবেই অংশ নেয় নি।
৪। মুসলিম বাহিনীর কষ্টের কথা জানতে পেরে – তাতে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে ইয়াজিদের খুশি হওয়াটা অবশ্যই কোনো জান্নাত প্রত্যাশী কামেলদার ব্যক্তির আলামত হতে পারে না।
৫। ইয়াজিদের এ খুশি হওয়ার খবর পেয়ে হযরত মুয়াবিয়া (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) তাকে শাস্তি দিতে ঐ (নবম) বাহিনীতে পাঠাতে সিদ্ধান্ত নেন।
সুতরাং ইয়াজিদ কোনোভাবেই উল্লিখিত দু’টি হাদীছ শরীফাঈনে বর্ণিত প্রথম অভিযানে অংশ নেয় নি। যারা বলে অংশ নিয়েছিলো – তারা গোমরাহ ও মিথ্যেবাদী। ধন্যবাদ।