বিষাদ সিন্ধু ,কারবালা ও তাত্বিক পর্যালোচনা Bishad-shindhu and Karbala

=======================================
আব্বা প্রায় গল্পটি বলতেন, আজ থেকে প্রায় ৪০-৫০ বছর আগের কথা, ছোটবেলায় আমার আব্বা তার দূর সম্পর্কের এক দাদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ সময়টা ছিল দশই মহররম৷ সেই বুড়ো ছিলেন গ্রামের মাদবার ৷ বাবা গিয়ে দেখেন যে বাড়িতে মহররমের মিলাদ এর জন্য বিশাল আয়োজন চলছে ৷ সে সময় গ্রামের দুই তিন বাড়িতে গ্রামের বেশ কিছু লোক সারারাত ভর বিষাদ সিন্ধু পাঠ করত ৷
.
এই বুড়ো(মাদবার) মহররমের রাতে বিষাদ সিন্ধু পাঠ করতেন আর হু হু করে কঁদতেন৷ তিনি বিষাদ সিন্ধু কে সেভাবে সম্মান করতেন যেভাবে কোরআনকে সম্মান করা হয়৷ বিষাদ সিন্ধু বুকে ঠেকাতেন, চুমু খেতেন ৷ যা হোক,তার সঙ্গে গ্রামের যেসব লোক এই মিলাদে শরিক হতেন তাদের মাঝেও কান্নার রোল পড়ে যেত ৷ এভাবে চলত সারা রাত ৷ ঠিক ফজরের আগ দিয়ে মিলাদ শেষ হত এবং সবায় তাবারক নিয়ে বাড়ি ফিরতো ৷ এই হলো গ্রাম বাংলার মানুষের ইসলাম ৷
.
ইংরেজরা এদেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর হিন্দুরা তাদের মেনে নিলেও মুসলিমরা তাদের মেনে নেয়নি ৷ ক্রমাগত তারা বিদ্রোহ করতে থাকে তিতুমীর,সাইয়েদ আহমদ শহীদ, সেপাহী বিদ্রোহ আরও অনেক বিপ্লব সংগঠিত হয় যাতে মুসলমান দের অবদানই বেশি৷ পরাজিত জাতি হিসাবে এরা শাসক গোষ্ঠি থেকে দূরে সরতে থাকে ৷ কারণ মুসলমানদের কাছে যে শিক্ষা ছিল তার দ্বারা কখনই সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠিকে মনে নেয়া সম্ভব ছিলনা ৷
.
এদিকে জীবিত নেতারা কেউ পালাতক বা নির্বাসিত৷ নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজদের দয়ায় কোন মতে টিকে আছে৷ এসময় এমনিতেই মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক৷ তার উপর শিক্ষা না পেয়ে একটি মুর্খ প্রজন্ম তৈরী হয়৷ যারা পরিণত হয় উদ্দেশ্যহীন ও কুসংস্কারচ্ছন্ন এক জাতিতে৷ তারপরও এ মুসলিম সমাজ ছিল
এমন এক পোড়া খড়ের গাদা, যেখানে ক্রোমাগত ধোঁয়া উড়তে থাকে৷ কোরআন, হাদিস ও ইতিহাসের সামান্য একটু বাতাস দিলেই ধোঁয়া উড়তে খড়ের গাদা থেকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে৷
.
আমরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গোল্ডস্টোন এর বক্তব্য সম্পর্কে জানি ৷ মুসলমানদেরকে কোরআন থেকে দূরে সরে দেয়ার জন্য যতরকম চেষ্টা করা করা দরকার তারা করেছে৷ বাদ রাখেনি ইতিহাস কে বিকৃতি করতেও ৷
.
কারবালার ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে মসলিম মন থেকে মুছে দেয়া তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ৷ অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায়ের এই যুদ্ধের ইতিহাস তাদের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ ৷ আর মীর মোশারফ হোসেনের "বিষাদ সিন্ধু" তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ৷
.
সহায়ক বললে ভুল হবে এটা ব্রিটিশদেরই একটা এজেন্ডা ছিল ৷ ইংরেজ ভৃত্য মীর মোশাররফ হোসেন খুব সুচারু রূপে তা পালন করেছিলেন ৷ আপনাদের একটা পরিসংখ্যান দেই ৷ পরিসংখ্যানটা খন্দকার আবুল খায়ের (রহ) এর "শহীদে কারবালা" বই থেকে নেয়া ৷
.
তৎকালীন বৃটিশ বাংলায় প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার গ্রাম ছিল ৷ প্রায় প্রতিটি গ্রামে ৩/৪ টি করে বিষাদ সিন্ধু পৌঁছে গিয়েছিল/পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ আপনি হয়তো বলতে পারেন যে, বিষাদ সিন্ধু সেই সময়ে জনপ্রিয়তার কারণে ছড়িয়ে পড়েছিল ৷ কিন্তুু কথা হচ্ছে যে, ৫৮০ পৃষ্ঠার [প্রথম সংস্করণে] একটি বই সেই সময়ে ৩/৪ লাখ হার্ডকপি বই [গ্রামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী] ১৮৯০ সালের দিকে কোন প্রকাশকানীর সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল৷ এত খরচই বা কোথা থেকে এসেছিল!!
.
খন্দকার আবুল খায়ের রহমাতুল্লাহ তার বইয়ে ১৮ পৃষ্ঠায় লেখেন যে “কলকাতা মাদ্রাসার প্রবীণ হিন্দুস্থানী হুজুরদের নিকট থেকে এর যতটুকু তথ্য পেয়েছি তা হচ্ছে এই যে, ব্রিটিশ সরকার মীর মোশাররফ হোসেনকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন এবং পরিকল্পিত ভাবেই কারবালার মূল ঘটনাকে কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়ার উদ্দেশ্যে এই বইটি লেখা হয়েছিল এবং মোটা অংকের টাকা দিয়ে বই ছাপানোর এবং তা বাংলার মুসলমানদের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল"৷
.
আর এই বইটি যে একটি উপন্যাসের বই ৷ বইটি যেভাবে সাজানো হয়েছে তা দেখে বুঝার উপায় নাই যে, এটা একটি উপন্যাসের বই বা ইতিহাসের বই ৷ বিশ্বাস না হলে লিংক কমেন্টে দেয়া আছে দেখে নিতে পারেন৷ আর সে সময় বর্তমান সময়ে বাংলায় যেরকম বই আছে, তেমন বই কোন বইও ছিলনা যার মাধ্যমে সত্য ইতিহাস জানতে পারতো ৷ তাই স্বল্প শিক্ষিত ধর্ম প্রাণ মুসলমানরা ধর্মীয় বই পেয়ে লুফে নিয়ে ছিল৷ দেয়াও হয়েছিল সল্প মূল্যে বা বিনা মূল্যে৷
.
খন্দকার আবুল খায়ের (রহ) তার বইতে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন ৷ ঘটনা টি হচ্ছে " আমি ঝিকরগাছার পাশের গ্রাম পুরন্দরপুরে মুহাররমের আলোচনা করতে গিয়ে বললাম, বিষাদ সিন্ধু কোন ইতিহাস নয়, এটা একটা উপন্যাস মাত্র, এরমধ্যে সত্য-মিথ্যা সংমিশ্রণ রয়েছে, বললাম অনেক কথাই মিথ্যা এবং কাল্পনিক ৷ তখন ওই মাহফিলের একজন প্রবীণ মাদবার যিনি গ্রামের মাদবারী করেন এবং ভালো বৈষয়িক জ্ঞান রাখেন, গ্রামের লোক যার কথার উপরে কেউ কথা বলতে সাহস করে না, এমন এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে আমার কথার প্রতিবাদ করে বললেন," যা বইতে লেখা আছে তা কি মিথ্যা হতে পারে, আর যা মিথ্যা তা কি কেউ লিখতে পারে ......!!!
.
বিষাদ সিন্ধুর এই বিষাদ থেকে, এখনও আমরা মুক্ত হতে পারিনি৷ ১৩৬ বছর প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাঁদতে কাঁদতেই পার হয়ে গেল৷ মূর্খরা বা স্বল্প শিক্ষিতরা এটাকে ইতিহাস ভাবলেও আমরা শিক্ষিতরা জেনে উপন্যাস হিসেবে পড়লেও আমরা কখনো খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনি যে, কারবালার আসল ইতিহাস কি ছিল৷
.
ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে ইংরেজদের মাথা ব্যথার করণই বা কি? কেনইবা ইতিহাস বিকৃতি করা হলো ৷ আমরা কি সেটা কি কখনো খোঁজার চেষ্টা করেছি ?
.
বিষাদ সিন্ধুর পুরো ঘটনা সাজানো হয় একজন মেয়েকে কেন্দ্র করে ৷ ইয়াজিদ ও ইমাম হুসাইনের সংঘর্ষের মূল কারণ কথিত জয়নাব নামের মেয়েটি ৷ আর কারবালার আসল ইতিহাস হচ্ছে সত্যের বিরুদ্ধে অন্যায়ের লড়াই ৷ খেলাফত কুক্ষিগত কারীর বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই৷ জালিমের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত প্রতিরোধ৷ কিন্তু ভাবতেও লজ্জা লাগে যে, মীর মোশারফ হোসেন ইতিহাসের সঙ্গে কি ঘৃণ্য খেলাটাই না খেললেন৷
.
ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু চাননি যে, ইসলামী খিলাফাত রাজতন্ত্রের মুখে হারিয়ে যাক ৷ আর এর জন্য তিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছেন৷ আর তার এই লড়াই মুসলিমদের জন্য একটা উসুল ৷ মুসলমানদের রাজনীতিতে একটি মূলনীতি। পরাজয় জেনেশুনেও বাতিলের বিরোধিতা করতে হয়।
ইসলামী খেলাফত ছাড়া অন্য কোন ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা মুসলিমরা মেনে নিতে পারে না, তা রাজতন্ত্রই হোক আর মানব রচিত যে কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় হোক ৷
.
খেয়াল করেলে দেখবেন যে, সিপাহী বিদ্রোহের পর পরই বিষাদ সিন্ধুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কারবালার আসল শিক্ষা কে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় ৷ আর এর ঠিক পরপরই রেশমী রুমাল আন্দোলন ব্যর্থ হয় ৷
.
কারবালার ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের জীবনে প্রভাব রেখে আসছে৷ আমাদের জীবনে বিষাদসিন্ধুর প্রভাব আছে কিন্তু কারবালার প্রভাব নেই ৷ ইমাম হুসাইন (রা) এর রক্তে লেখা এই ফাতওয়া যদি আমাদের জীবনে প্রভাব রাখতো তাহলে আমাদের অবস্থাও সেই কারবালার ইমাম হোসাইন আবস্থানে থাকতাম৷ ইসলামের এই অবস্থা হতো না ৷ আল্লাহ আমাদেরকে কারবালার ইতিহাস থেকে সঠিক শিক্ষা নিয়ে জীবন চলার তৌফিক দান করুন ৷ আমীন।

No comments:

Post a Comment

‘ তোমরা আমার ভাইকে হত্যা করতে পারবে না।‘ - ইয়াজিদের রাজদরবারে ইমাম হোসাইনের বোন হযরত যায়নাব

‘ কারবালার দু’ পীঠ আছে। একটি আলোকময় আর একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইমাম হোসাইন (আ.) সত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাথিগণসহ কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন। এটি আলোকময় দিক । ইয়াযীদের দল সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে ক্ষণিকের জন্য বাহ্যিকভাবে বিজয়ী হলেও এ দিকটি হলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। সারা বিশ্বের মানুষ তাদের ঘৃণার সাথে স্মরণ এবং অভিসম্পাত করে । ইমাম হোসাইন ও তার সাথিগণকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। ইমাম হোসাইন (আ.) শাহাদাতের পর আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। ইয়াযীদের দল তাকে শহীদ করে ভেবেছিল সব কিছু মিটে গেল। কিন্তু জীবিত হোসাইন হতে মৃত হোসাইন আরও বেশি মারাত্মক হয়ে তাদের পতনকে আর ত্বরান্বিত করে দিয়েছেন। অনুভূতিসম্পন্ন প্রতিটি মানবের মণিকোঠায় তিনি জীবন্ত থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার উদ্যম যোগাচ্ছেন। তার বোন হযরত যায়নাব (আ.) সত্যিই বলেছেন-‘ তোমরা আমার ভাইকে হত্যা করতে পারবে না।‘ ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের ফলে ইয়াযিদী ইসলামের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদী ইসলামের আত্মিক ও বাস্তব উভয় প্রকার বিজয় সংঘটিত হয়েছিল । - মাওলানা মোহাম্মদ কুতুবউদ্দীন হোসাইনী চিশতী