আশুরার রোজা: নিয়ম ও ফজিলত Ashurar Roza


মহররম মাস।  হিজরি বর্ষের প্রথম মাস।  মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর নিকট মর্যাদাপূর্ণ মাস। এ মাসের দশম তারিখও মহান আল্লাহর নিকট পূণ্যময়। 

এদিনটির রয়েছে বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলত। আগামী শুক্রবার এ দিবসটি পালিত হবে। ইসলামের ভাষায় এ দিনটিকে বলা হয় ‘পবিত্র আশুরা’।
 
‘আশুরা’ শব্দটি আরবি ‘আশারা’ শব্দ থেকে উৎপত্তি। আশারা অর্থ হচ্ছে দশ আর আশুরা অর্থ হল দশম দিবস। এই দিনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক আমল রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো রোজা পালন করা। রাসূল (সা.) এই আশুরার দিন রোজা পালন করতেন। উম্মতদেরকেও এ দিনে রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।

আশুরার রোজার ইতিহাস:

রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজার ফরজ বিধান রহিত হয়ে তা নফল হয়। রাসূল (সা:) এ নিয়মে রোজা রাখতেন। তিনি যখন হিজরত করে মদিনায় গেলেন তখন  রাসূল (সা:) দেখলেন, ইয়াহুদিরা এই দিনে রোজা পালন করছে, রাসূল (সা:) কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, এই দিনে আমাদের নবী হজরত মুসা (আ:) জালেম ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই আমাদের নবী মুসা (আ:) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য এ দিন রোজা পালন করতেন। এ জন্য আমাদের নবীর অনুসরণ করে আমরা এই দিনে রোজা পালন করি। তখন রাসূল (সা:) বললেন ‘আমরাই বেশি হকদার মুসা (আ:) এর সঙ্গে সুসম্পর্কের’। তারপর তিনি সাহাবাদেরকেও এ দিনের রোজা রাখার নির্দেশ দেন।

হাদীসের আলোকে আশুরার রোজা:

হজরত আয়েশা (রা:) বলেন, ‘জাহেল যুগে এই দিন কুরাইশরা রোজা পালন করতেন। রাসূল (সা:) এদিন রোজা নিজে রেখেছেন এবং সাহাবীদের রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজাকে ইচ্ছাধীন করে দিয়েছেন।’ (বুখারী ১৮৯৮, তিরমিজী ৭৫৩)

আয়শা (রা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.)-কে আমি দেখিনি কোনো দিনের রোজাকে অন্য দিনের তুলনায় এতটা গুরুত্ব দিতে, আশুরার দিন আর রমাজান ব্যতীত’।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (সহীহ বুখারী ১/২১৮)

অন্য হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮)

আশুরার রোজার নিয়ম:

আশুরার রোজা সম্পর্কে এক হাদীসে এসেছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ ১/২৪১)

ইবনে আব্বাস (রা.) একবার বললেন, হে আল্লাহর নবী! এ দিনটিকে ইহুদিরা সমীহ পূর্বক রোজা রাখে। আমাদের রোজাও তাদের সদৃশ হয়ে যায়। রাসূল (সা.) বললেন, যদি আমি আগামী বছর জীবিত থাকি, তবে নবম তারিখটিকেও দশমের সঙ্গে মিলিয়ে  রোজা রাখব, ইনশাআল্লাহ’! পরের বৎসরটি আর আসেনি রাসূল (সা.) এর জীবনে।
 
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ইয়াহুদিরা আশুরার একদিন রোজা রাখত। তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয় সে দিকে খেয়াল রেখে আশুরার পূর্বের দিন ৯ তারিখ বা পরের দিন ১১ তারিখ অতিরিক্ত একটি রোজা রাখা উত্তম। 
ওলামায়ে কেরাম এই ক্ষেত্রে চারটি ধারা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন সর্বোত্তম হলো নয় এবং দশ তারিখ রোজা রাখা। দ্বিতীয় ধাপে বলেছেন ১০ এবং ১১। তৃতীয় ধাপে বলেছেন ৯, ১০, ১১ এই তিনদিন একাধারে এবং চতুর্থ ধাপে বলেছেন সমস্যা থাকলে শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখতে। কারণ রাসুল (সা.) ৯ এবং ১০ তারিখ রোজা রাখার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। এজন্য অনেকেই বলছেন যে নয়, ১০ রোজা রাখাই উত্তম। কেউ যদি নয় তারিখ রাখতে ব্যর্থ হন, সে ১০, ১১ রাখবেন বা শুধু ১০ তারিখেও মহররমের রোজা রাখতে পারবেন।

আশুরার রোজা নিয়ে সাহাবাদের আমল:

বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, হজরত ইবনে ওমর (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী (সা:) আশুরার রোজা রেখেছেন এবং রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তবে যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তিনি এ নির্দেশ পরিহার করেন। তাই হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তার নির্ধারিত নফল রোজার দিন না হলে আশুরার এ দিনের রোজা রাখতেন না।

এসব হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নবী (সা:) রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার সিয়াম পালনকে নির্দেশ শিথিল করে নেন। এরপর এ দিনের রোজা বাধ্যতামূলক ছিল না। এ দিনের রোজা পালন মুস্তহাব বা সুন্নতের পর্যায়ে রয়ে যায়। তারপরও ওমর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আউফ আবু মূসা, কায়স ইবনে সাদ, ইবনে আব্বাস প্রমুখ থেকে এ দিনের রোজা রাখা প্রমাণিত হয়। নবী (সা.) তাঁর জীবনের শেষ দিকে এ দিনের সঙ্গে অন্য এক দিনসহ রোজা রাখার সঙ্কল্প করেন।

আশুরার রোজা নিয়ে তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনদের মতামত:

ইবনুল কাইয়্যেম (রহ:) জাদুল মা’আদ এ উল্লেখ করেন, ‘আশুরার দিবসের রোজার তিনটি গ্রেড রয়েছে। সর্বোচ্চ গ্রেড হচ্ছে এর আগে ও পরে মোট তিনটি রোজা রাখা; তারপর হচ্ছে ৯ ও ১০ এ দুই দিনের রোজা রাখা। বেশির ভাগ হাদিস এভাবে এসেছে। এরপর হচ্ছে কেবল ১০ তারিখের রোজা রাখা। এ বক্তব্য থেকে এটাও প্রতীয়মান হয়  যে, শুধু ১০ তারিখের রোজা রাখা মাকরুহ নয়।

আশুরার রোজায় যে গুনাহ মাফ হয়:

আশুরার রোজা দ্বারা শুধু সগিরা গুনাহ মাফ হবে। কবিরা গুনাহ বিশেষ তওবা ছাড়া মাফ হয় না। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘আশুরার রোজা সকল সগিরা গুনাহ মোচন করে। হাদিসের বাণীর মর্ম রুপ হচ্ছে, কবিরা গুনাহ ছাড়া সকল গুনাহ মোচন করে দেয়। এরপর তিনি আরো বলেন, আরাফার রোজা দুই বছরের গুনাহ মাফ করে। আর আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহ মাফ করে। 

মুক্তাদির ‘আমীন’ বলা যদি ফেরেশতাদের আমীন বলার সঙ্গে মিলে যায় তাহলে পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। উল্লিখিত আমলগুলোর মাধ্যমেও পাপ মোচন হয়। যদি বান্দার সগিরা গুনাহ থাকে তাহলে সগিরা গুনাহ মোচন করে। যদি সগিরা বা কবিরা কোনো গুনাহ না থাকে তাহলে তার আমলনামায় নেকি লেখা হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। যদি কবিরা গুনাহ থাকে, সগিরা গুনাহ না থাকে তাহলে কবিরা গুনাহকে কিছুটা হালকা করার আশা করতে পারি।’ (আল-মাজমু শারহুল মুহাযযাব, খ-৬)

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘পবিত্রতা অর্জন, নামাজ আদায়, রমজানের রোজা রাখা, আরাফার দিন রোজা রাখা, আশুরার দিন রোজা রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে শুধু সগিরা গুনাহ মাফ হয়। (আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, খ-৫)

অতএব, আসুন আমরা আশুরার রাতে বেশি বেশি করে নফল নামাজ, তাসবিহ তাহলীলসহ অতিরিক্ত হারে তাওবা ও কৃত কর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে পারি। মহান আল্লাহ যেন আমাদের হায়াত বাড়িয়ে দেয় সে জন্য তার নিকট প্রর্থনা করতে হবে।  

সারাটি বছর যেন রাঙিয়ে দেওয়া যায়, সে জন্য এখন থেকেই জীবনকে গড়ে তুলতে হবে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ এই দিনে অপসাংস্কৃতি ও ইসলাম নিষিদ্ধ করছে এমন কোনো কর্মকাণ্ড যেন আমার বা আমাদের দ্বারা সংগঠিত না হয়। 

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

Source: www.daily-bangladesh.com

No comments:

Post a Comment

‘ তোমরা আমার ভাইকে হত্যা করতে পারবে না।‘ - ইয়াজিদের রাজদরবারে ইমাম হোসাইনের বোন হযরত যায়নাব

‘ কারবালার দু’ পীঠ আছে। একটি আলোকময় আর একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইমাম হোসাইন (আ.) সত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাথিগণসহ কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন। এটি আলোকময় দিক । ইয়াযীদের দল সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে ক্ষণিকের জন্য বাহ্যিকভাবে বিজয়ী হলেও এ দিকটি হলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। সারা বিশ্বের মানুষ তাদের ঘৃণার সাথে স্মরণ এবং অভিসম্পাত করে । ইমাম হোসাইন ও তার সাথিগণকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। ইমাম হোসাইন (আ.) শাহাদাতের পর আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। ইয়াযীদের দল তাকে শহীদ করে ভেবেছিল সব কিছু মিটে গেল। কিন্তু জীবিত হোসাইন হতে মৃত হোসাইন আরও বেশি মারাত্মক হয়ে তাদের পতনকে আর ত্বরান্বিত করে দিয়েছেন। অনুভূতিসম্পন্ন প্রতিটি মানবের মণিকোঠায় তিনি জীবন্ত থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার উদ্যম যোগাচ্ছেন। তার বোন হযরত যায়নাব (আ.) সত্যিই বলেছেন-‘ তোমরা আমার ভাইকে হত্যা করতে পারবে না।‘ ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের ফলে ইয়াযিদী ইসলামের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদী ইসলামের আত্মিক ও বাস্তব উভয় প্রকার বিজয় সংঘটিত হয়েছিল । - মাওলানা মোহাম্মদ কুতুবউদ্দীন হোসাইনী চিশতী